কিশোরগঞ্জে ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তার ১৩ কোটি টাকা আত্মসাৎ তদন্তে ফেঁসে যাচ্ছেন ডিসিসহ ছয়জন

হাওর বার্তা ডেস্কঃ কিশোরগঞ্জের  সাবেক ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা সেতাফুল ইসলামের ১৩ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনায় জেলা প্রশাসক বা ডিসিসহ ছয় কর্মকর্তা ফেঁসে যাচ্ছেন। তাঁদের অভিযুক্ত করে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন ভূমি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মির্জা তারিক হিকমত। ভূমিসচিবের কাছে দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদনটি পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে।

তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী সেতাফুল ইসলামের সঙ্গে যাঁরা ফেঁসে যাচ্ছেন তাঁরা হলেন—কিশোরগঞ্জের ডিসি মো. আজিমুদ্দিন বিশ্বাস, জেলা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মো. সিরাজুল ইসলাম, জেলা হিসাবরক্ষণ অফিসের সুপার মো. গোলাম হায়দার, একই অফিসের অডিটর মো. সৈয়দুজ্জামান এবং সোনালী ব্যাংকের কিশোরগঞ্জ শাখার ম্যানেজার।

প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, অভিযুক্ত ছয়জনের মধ্যে ডিসি ফেঁসে যাচ্ছেন ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা সেতাফুল ইসলামের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়ার পরও ব্যবস্থা না নেওয়ার জন্য। অভিযোগ নিয়ে তদন্তের আওতায় থেকেও সেতাফুল একের পর এক আত্মসাতের ঘটনা ঘটিয়েছেন। হিসাব না নিয়ে ডিসি উল্টো সেতাফুলকে অবমুক্ত করে দিয়েছেন। ভূমি মন্ত্রণালয়ের তদন্ত চলা অবস্থায় সেতাফুল পাঁচ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন।

জেলা হিসাবরক্ষণ অফিসার মো. সিরাজুল ইসলাম, সুপার মো. গোলাম হায়দার এবং অডিটর মো. সৈয়দুজ্জামান ফেঁসে যাচ্ছেন আট কোটি ৯ লাখ ৭০ হাজার এবং পাঁচ কোটি টাকার চেকের পেমেন্ট অর্ডার দেওয়ার সময় সতর্কতা অবলম্বন না করার জন্য। জেলা হিসাবরক্ষণ অফিসের ওই কর্মকর্তারা সেতাফুল ইসলামকে আর্থ আত্মসাতে সহযোগিতা করেছেন বলে মির্জা তারিক হিকমত প্রতিবেদনে জানিয়েছেন।

পাঁচ কোটি টাকার চেকের প্রাপকের ঘরে ‘সেলফ’ লেখা ছিল এবং সেতাফুল ইসলামের স্বাক্ষরের নিচে কোনো সরকারি সিল ছিল না। সরকারি চেকে পদবি এবং স্বাক্ষরের নিচে অফিসিয়াল সিল ব্যবহার করার নিয়ম থাকলেও এ ক্ষেত্রে তা অনুসরণ করা হয়নি। কেন করা হয়নি তা নিয়ে ব্যাংকও কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করেনি। এ কারণে ব্যাংকের ম্যানেজারকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।

তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তা ও ভূমি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মির্জা তারিক হিকমত  বলেন, ‘আমি ভূমি সচিবের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছি। পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য তা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।’ এর বাইরে কোন কথা বলতে আপত্তি জানান তিনি।

বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ডের জন্য কিশোরগঞ্জে কয়েক শ একর ভূমি অধিগ্রহন করা হয়। এসব ভূমির মালিককে ক্ষতিপূরনের টাকা দেওয়ার সময় জালিয়াতির আশ্রয় নেন কিশোরগঞ্জের সাবেক ভূমি অধিগ্রহন কর্মকর্তা মো. সেতাফুল ইসলাম। দফায় দফায় অসংখ্য ভূমি অধিগ্রহন চেকের মধ্যে সেতাফুল ইসলাম ১৩ কোটি ৯ লাখ ৭০ হাজার টাকা আত্মসাত করেন। ওই অভিযোগে সেতাফুলকে গত ১৭ জানুয়ারি গ্রেপ্তার করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

ভূমি মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, সেতাফুলের আট কোটি ৯ লাখ ৭০ হাজার টাকার আর্থিক অনিয়ম খতিয়ে দেখতে ভূমি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মির্জা তরিকুল হায়দারকে তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করে ভূমি মন্ত্রণালয়। তাঁর তদন্তকাজ চলার সময় সেতাফুল আরো পাঁচ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন। মির্জা তারিক হিকমতকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়ার আগেই সেতাফুল ইসলামের আর্থিক অনিয়ম নিয়ে প্রতিবেদন দেন কিশোরগঞ্জের তখনকার দুই অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মনিরুল ইসলাম পাটোয়ারী ও দুলাল চন্দ্র সূত্রধর। তাঁরা উভয়েই সেতাফুল ইসলামের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দিলেও ডিসি কোনো সিদ্ধান্ত দেননি। ওই সব প্রতিবেদনে ক্ষতিপূরণের প্রতিটি চেক পাস করার আগে ডিসি বা এডিসির মাধ্যমে যাচাই করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। ওই সব কমিটি সেতাফুলের কাছ থেকে আট কোটি ৯ লাখ ৭০ হাজার টাকা আদায় করারও সুপারিশ করেছিল। একই সঙ্গে ইস্যুকৃত কিন্তু পাওয়া যায়নি এমন ১৩টি চেক ফেরত দিতে সেতাফুলকে বাধ্য করার সুপারিশ করা হয়েছিল। পরে সেতাফুল ওই ১৩টি চেকের দুটি ব্যবহার করে আরো পাঁচ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন। এরই মধ্যে সেতাফুলকে পিরোজপুরে বদলি করা হয়। আগের তদন্ত প্রতিবেদনের আলোকে কোনো ব্যবস্থা না নিয়েই ডিসি গত ৫ ডিসেম্বর তাঁকে কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসন থেকে অবমুক্ত করে দেন। হিসাব না নিয়ে অবমুক্ত করায় ফেঁসে যাচ্ছেন কিশোরগঞ্জের ডিসি।

ভূমি মন্ত্রণালয় গত ১৮ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে কিশোরগঞ্জের ডিসির কাছে এসংক্রান্ত ব্যাখ্যা নেওয়ার তাগিদ দিয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় শিগগিরই কিশোরগঞ্জের ডিসিকে তলব করবে বলে জানা গেছে।

ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তার অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে জানতে চাইলে কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক আজিমুদ্দিন বিশ্বাস কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অধিগ্রহণ কর্মকর্তা সেতাফুল ইসলাম এলএ চেক নিজের হেফাজতে রাখতেন। যদিও প্রচলিত বিধান অনুযায়ী এলএ চেক বই অফিস সহকারীর সংরক্ষণ করার কথা। এ নিয়ম সেতাফুল কিশোরগঞ্জে যোগদানের আগেও মানা হতো। কিন্তু তিনি কিশোরগঞ্জে যাওয়ার পর তা পাল্টে দেওয়া হয়।

মির্জা তারিক হিকমত প্রতিবেদনে আরো বলেছেন, সেতাফুল ইসলাম ৪৮টি ক্ষতিপূরণের চেক বিভিন্ন ব্যক্তির নামে ইস্যু করেন, যার কোনো টাইটেল ঠিকমতো পাওয়া যায়নি। ভূমি অধিগ্রহণ শাখার লেজার বইয়ে ওই চেকগুলোর কোনো এন্ট্রি নেই। এসব চেকের মধ্যে মুড়ি অংশে যে পরিমাণ টাকা লেখা আছে জেলা হিসাবরক্ষণ অফিসের হিসাব বইয়ে ভিন্ন পরিমাণ লেখা। ক্ষতিগ্রস্ত মঞ্জু মিয়ার চেকের মুড়িতে লেখা আছে ২৫ লাখ টাকা। কিন্তু হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার কার্যালয়ের হিসাব অনুযায়ী এ চেকে টাকার পরিমাণ ৬৮ লাখ। এভাবে বিভিন্ন ব্যক্তির নামে ৪৮টি চেকের মাধ্যমে মোট আট কোটি ৯ লাখ ৭০ হাজার টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। সেতাফুল একটি চেকে পাঁচ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। সেই চেকের মুড়িতেও ক্ষতিগ্রস্ত জাহের মিয়ার নামে সাত লাখ ৩২ হাজার ৯৬১ টাকা লেখা ছিল।

সেতাফুল ইসলামের কাছ থেকে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ১৪০টি চেকের প্রাপকের অংশ উদ্ধার করেন। এসব চেকের ১৩৮টির মুড়িতে প্রাপকের নাম ও টাকার পরিমাণ লেখা ছিল। এসব চেক ভাঙানো হয়নি। এসব চেকের টাকাও আত্মসাৎ করা হতো বলে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের (রাজস্ব) নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে ১৩টি চেকের সন্ধান নেই বলে জানানো হয়। এই ১৩টি চেকের একটি ব্যবহার করে সেতাফুল পাঁচ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এই ১৩ চেকের একটি উদ্ধার করা হয়েছে, যেখানে ১০ কোটি টাকা লেখা ছিল। সংশ্লিষ্ট হিসাবে পাঁচ কোটি টাকা না থাকায় সেতাফুল ইসলাম জেলা হিসাবরক্ষণ অফিসারকে অন্য হিসাব থেকে তা স্থানান্তরের অনুরোধ জানান। এই অনুরোধপত্রটির স্মারক নম্বরও ভুয়া ছিল।

সাধারণ মানুষের ঘরবাড়ি ভেঙে, বসত-ভিটা থেকে তাদের উচ্ছেদ করে ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ করা হয়। গড়ে তোলা হয় বিশ্ববিদ্যালয় বা বিচারালয়সহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান। বিনিময়ে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হওয়া ক্ষতিগ্রস্তরা দুই গুণ বা তিন গুণ ক্ষতিপূরণ পায়। ক্ষতিপূরণ পাওয়ার আগেই বাপ-দাদার ভিটা ছেড়ে নতুন আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটে চলে ক্ষতিগ্রস্তরা। সরকারি অফিসের বারান্দায় ঘুরে ঘুরে তারা একসময় ক্ষতিপূরণ পায়। আবার অনেকে আমলাতান্ত্রিক চক্করে পড়ে ঘুরতেই থাকে। অনেকের ক্ষতিপূরণের টাকা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ভাগজোগ করে খেয়ে ফেলেন।

স্বাধীনতার পর কিশোরগঞ্জে তেমন উন্নয়ন হয়নি। এ অবস্থার অবসান ঘটনার জন্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের জেলা কিশোরগঞ্জের জন্য ব্যাপক উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। কিশোরগঞ্জে একটি ক্যান্টনমেন্ট করা হবে। মিঠামইনে প্রস্তাবিত এ ক্যান্টনমেন্টের অধীনে একটি রিভারাইন (নদীতীরবর্তী) ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাটালিয়নও গড়ে তোলা হবে। মিঠামইনের এই ক্যান্টনমেন্টের জন্য ৯৫০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে। ২৯ কিলোমিটার দীর্ঘ ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম রাস্তার জন্য ৫০০ একর জমি অধিগ্রহণ হচ্ছে। কিশোরগঞ্জ সদর থেকে করিমগঞ্জ-মিঠামইন হয়ে ইটনার ৩৭ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কের জন্য ২০০ একর জমি নেওয়া হচ্ছে। কিশোরগঞ্জ সদর থেকে পাকুন্দিয়া ও কাপাসিয়া হয়ে ঢাকা সড়কের জন্য ১৮ একর জমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে। আজমিরীগঞ্জ-ইটনা-মিঠামইন-করিমগঞ্জ সদর ও পাকুন্দিয়া হয়ে শ্রীপুর গ্যাসলাইনের জন্য ১৫০ একর জমি অধিগ্রহণের কাজ শেষ হয়েছে। ভৈরবে শিল্পনগরী গড়ে তোলার জন্য ৪১ একর, পানি উন্নয়ন বোর্ডের কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ৭০০ একর, হোসেনপুরে টেক্সটাইল কলেজের জন্য আট একর, হাওর বিশ্ববিদ্যালয় করার জন্য করিমগঞ্জে ২০০ একর এবং কটিয়াদীতে হাইটেক পার্ক করার জন্য ৪০০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর